বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৫৪ অপরাহ্ন
মুহাম্মদ আব্দুল বাছির সরদার:
সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলেও উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সংশয়ে রয়েছেন কৃষকরা। সময়মতো বৃষ্টি হওয়ার পরও ধান গাছের বৃদ্ধি হার কম, ছত্রাকে আক্রান্ত হওয়া, পুড়ে যাওয়া, পোকার আক্রমণসহ নানা কারণে এখন পর্যন্ত ধানের ভালো ফলন নিয়ে শঙ্কা কাটছেনা কৃষকদের। স্থানীয় কৃষি অফিসের মতে, চলতি বছর দিরাইয়ে বোরো ধান উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হওয়ার ব্যাপারে তারা শতভাগ আশাবাদী।
বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, প্রতি বছরই দিরাইয়ে বোরো জমি কমছে। বেশি লাভের আশায় অনেকেই বোরো ধান না করে সেই জমিকে পুকুরে পরিণত করা, বাড়ি নির্মাণ, রাস্তা-ঘাট তৈরিসহ নানাভাবে জমি কমছে। তবে কৃষি অফিসের দেয়া তথ্য মতে, গত কয়েক বছর থেকে ধানের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় আগের চেয়ে বেশি বোরো ধান আবাদ হচ্ছে। চলতি বছর দিরাই উপজেলায় ৩৯ হাজার কৃষক বোরো ধান আবাদ করেছেন। তারা আরও জানান, আগে যে জমি হাওরের বাইরে পতিত থাকতো, এখন সেই জমিতে ধানের চাষ হচ্ছে। ফলে একদিকে পতিত জমিতে আবাদ হচ্ছে, অন্যদিকে কৃষক বাড়তি লাভ করছে।
সূত্র জানায়, এ বছর দিরাইয়ে মোট ৩০ হাজার ১১০ হেক্টর বোরো জমি আবাদ করা হয়েছে। এরমধ্যে হাওরে ২৮ হাজার ৪৩০ হেক্টর ও হাওরের বাইরে (পতিত জমিতে) ১ হাজার ৬৮০ হেক্টর। হাইব্রিড মোট ১৩ হাজার ৮৭৭ হেক্টর, হাওরে ১২ হাজার ৫১২ হেক্টর ও হাওরের বাইরে ১ হাজার ৩৬৫ হেক্টর। উফসি মোট ১৫ হাজার ৯৮৮ হেক্টর, হাওরে ১৫ হাজার ৬৮৮ হেক্টর ও হাওরের বাইরে ৩শত হেক্টর। স্থানীয় মোট ২৪৫ হেক্টর, হাওরে ২শত হেক্টর ও হাওরের বাইরে ১৫ হেক্টর।
দিরাই উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর বোরো ধান উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ২৮ হাজার ১০৩ মেট্রিক টন চাউল। গত বছর আবাদের লক্ষ্যমাত্রা এ বছরের সমান থাকলেও উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ২৭ হাজার ৮১৪ মেট্রিক টন চাউল। তবে সেই লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে উৎপাদন হয়েছে ১ লাখ ২৮ হাজার ৩৩৪ মেট্রিক টন চাউল। এ বছর বোরোতে ৩০টি প্রদর্শনী প্লট করা হয়েছে বলে সূত্র জানায়।
দিরাই উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, ৯টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার ২৮টি ব্লকের মধ্যে চরনারচর ব্লকে হাওরে হাইব্রিড ৪৭৫ হেক্টর, উফসি ৬৫০ হেক্টর, স্থানীয় ৭ হেক্টর; হাওরের বাইরে হাইব্রিড ৯১ হেক্টর, উফসি ১৫ হেক্টর, স্থানীয় ২ হেক্টর। শ্যামারচর ব্লকে হাওরে হাইব্রিড ৪৮০ হেক্টর, উফসি ৬৫২ হেক্টর, স্থানীয় ৭ হেক্টর; হাওরের বাইরে হাইব্রিড ১শত হেক্টর, উফসি ১৪ হেক্টর, স্থানীয় ২ হেক্টর। পেরুয়া ব্লকে হাওরে হাইব্রিড ৪৭০ হেক্টর, উফসি ৬৫৩ হেক্টর, স্থানীয় ৬ হেক্টর; হাওরের বাইরে হাইব্রিড ১০১ হেক্টর, উফসি ১৬ হেক্টর, স্থানীয় ১ হেক্টর। রাজানগর ব্লকে হাওরে হাইব্রিড ৩৫৬ হেক্টর, উফসি ৪২০ হেক্টর, স্থানীয় ৭ হেক্টর; হাওরের বাইরে হাইব্রিড ১৬৭ হেক্টর, উফসি ৩০ হেক্টর, স্থানীয় ৩ হেক্টর। গচিয়া ব্লকে হাওরে হাইব্রিড ৫৩৪ হেক্টর, উফসি ৪৫৫ হেক্টর, স্থানীয় ৭ হেক্টর। রন্নারচর ব্লকে হাওরে হাইব্রিড ৪৬০ হেক্টর, উফসি ৪৪০ হেক্টর, স্থানীয় ৬ হেক্টর; হাওরের বাইরে হাইব্রিড ৮৩ হেক্টর, উফসি ১৫ হেক্টর, স্থানীয় ২ হেক্টর। রফিনগর ব্লকে হাওরে হাইব্রিড ৪৫০ হেক্টর, উফসি ৭১৫ হেক্টর, স্থানীয় ১২ হেক্টর। বলনপুর ব্লকে হাওরে হাইব্রিড ৪৭০ হেক্টর, উফসি ৭১৩ হেক্টর, স্থানীয় ১৩ হেক্টর। খাগাউড়া ব্লকে হাওরে হাইব্রিড ৫১৭ হেক্টর, উফসি ৭শত হেক্টর, স্থানীয় ১০ হেক্টর। ভাটিপাড়া ব্লকে হাওরে হাইব্রিড ৩২০ হেক্টর, উফসি ৪৬৮ হেক্টর, স্থানীয় ৮ হেক্টর। শরিফপুর ব্লকে হাওরে হাইব্রিড ৩২১ হেক্টর, উফসি ৪৫০ হেক্টর, স্থানীয় ৬ হেক্টর; হাওরের বাইরে হাইব্রিড ১৫০ হেক্টর, উফসি ৪৫ হেক্টর। মধুরাপুর ব্লকে হাওরে হাইব্রিড ৩২২ হেক্টর, উফসি ৪৮৭ হেক্টর, স্থানীয় ৮ হেক্টর। করিমপুর ব্লকে হাওরে হাইব্রিড ৩৮৫ হেক্টর, উফসি ৩৮০ হেক্টর, স্থানীয় ৭ হেক্টর; হাওরের বাইরে হাইব্রিড ৪৫ হেক্টর, উফসি ১০ হেক্টর। সাকিতপুর ব্লকে হাওরে হাইব্রিড ৩৯৫ হেক্টর, উফসি ৩৯৫ হেক্টর, স্থানীয় ৭ হেক্টর; হাওরের বাইরে হাইব্রিড ৫০ হেক্টর, উফসি ১৫ হেক্টর। বদলপুর ব্লকে হাওরে হাইব্রিড ৩৮০ হেক্টর, উফসি ৩৯৫ হেক্টর, স্থানীয় ৬ হেক্টর; হাওরের বাইরে হাইব্রিড ৫৫ হেক্টর, উফসি ২০ হেক্টর। তাড়ল ব্লকে হাওরে হাইব্রিড ৪৭০ হেক্টর, উফসি ৩৯৫ হেক্টর, স্থানীয় ৯ হেক্টর। বাউসি ব্লকে হাওরে হাইব্রিড ৪৬০ হেক্টর, উফসি ৫০৫ হেক্টর, স্থানীয় ৮ হেক্টর। আমিরপুর ব্লকে হাওরে হাইব্রিড ৪৬০ হেক্টর, উফসি ৫২০ হেক্টর, স্থানীয় ৮ হেক্টর। কুলঞ্জ ব্লকে হাওরে হাইব্রিড ৪৪০ হেক্টর, উফসি ৮২০ হেক্টর, স্থানীয় ৭ হেক্টর; হাওরের বাইরে হাইব্রিড ৬০ হেক্টর, উফসি ১০ হেক্টর, স্থানীয় ২ হেক্টর। গলিশাইল ব্লকে হাওরে হাইব্রিড ৪৬০ হেক্টর, উফসি ৮১৫ হেক্টর, স্থানীয় ৮ হেক্টর; হাওরের বাইরে হাইব্রিড ৬৫ হেক্টর, উফসি ৮ হেক্টর, স্থানীয় ১ হেক্টর। টংগর ব্লকে হাওরে হাইব্রিড ৪৮০ হেক্টর, উফসি ৮শত হেক্টর, স্থানীয় ৮ হেক্টর; হাওরের বাইরে হাইব্রিড ৭৫ হেক্টর, উফসি ১৭ হেক্টর, স্থানীয় ২ হেক্টর। জগদল ব্লকে হাওরে হাইব্রিড ৫৫০ হেক্টর, উফসি ৬৭০ হেক্টর, স্থানীয় ১০ হেক্টর। নগদীপুর ব্লকে হাওরে হাইব্রিড ৫৫৫ হেক্টর, উফসি ৬৯০ হেক্টর, স্থানীয় ১০ হেক্টর। কলিয়ারকাপন ব্লকে হাওরে হাইব্রিড ৫৫৫ হেক্টর, উফসি ৬৯৫ হেক্টর, স্থানীয় ১০ হেক্টর। সরমঙ্গল ব্লকে হাওরে হাইব্রিড ৪২২ হেক্টর, উফসি ৪০৫ হেক্টর, স্থানীয় ৮ হেক্টর। কল্যানী ব্লকে হাওরে হাইব্রিড ৩শত হেক্টর, উফসি ৩৯৫ হেক্টর, স্থানীয় ৭ হেক্টর; হাওরের বাইরে হাইব্রিড ১৫০ হেক্টর, উফসি ৪৫ হেক্টর। নাচনী ব্লকে হাওরে হাইব্রিড ৩৬০ হেক্টর, উফসি ৪০৫ হেক্টর, স্থানীয় ৮ হেক্টর। পৌরসভা ব্লকে হাওরে হাইব্রিড ৬৬৫ হেক্টর, উফসি ৪৫৫ হেক্টর, স্থানীয় ১২ হেক্টর; হাওরের বাইরে হাইব্রিড ১৬৫ হেক্টর, উফসি ৩০ হেক্টর।
এদিকে বেশি ধান উৎপাদনের আশায় জমিতে হাইব্রিডের আবাদ বাড়ছে, ফলে হারিয়ে যাচ্ছে দেশি ধানের জাত। এ বছর দিরাইয়ে মাত্র ৫ জাতের দেশি ধানের আবাদ করা হয়েছে বলে কৃষি অফিস সূত্র জানায়।
এ বছর দিরাইয়ে হাইব্রিড জাতের হিরা ধান হাওরে ১৯৩২ হেক্টর, হাওরের বাইরে ১শত হেক্টর, জনকরাজ যথাক্রমে ৩৬৮০ ও ৩৯৮ হেক্টর, আগমনী ৩শত ও ৭৫ হেক্টর, অগ্রণী ৬শত ও ৫০ হেক্টর, এসিআই ৫শত ও ১২৫ হেক্টর, কৃষিবিদ ৭শত ও ২৫০ হেক্টর, ব্র্যাক-৪৪৪ ৩শত ও ১শত হেক্টর, সচ্ছল ২৫০ হেক্টর, আফতাব ৩৭৫ ও ৫০ হেক্টর, এসএল-৮ ৪শত ও ৭৫ হেক্টর, সোনার বাংলা ২শত ও ৫০ হেক্টর, সুগন্ধা ৪৫০ হেক্টর, রংধনু ১৭৫ হেক্টর, পাইওনিয়র ৭৫ হেক্টর, পারটেক্স ২৫০ হেক্টর, দুর্বার ১২৫ হেক্টর, ইস্পাহানী ২৫০ হেক্টর, নবীন ১২৫ হেক্টর, বৈশাখী ১৭৫ হেক্টর, ঝলক ২শত হেক্টর, চমক ১৫০ হেক্টর, বেবিলন ৫০ হেক্টর, নাফকো-২ ৭শত ও ৯২ হেক্টর, রূপালী-৭ ২৫ হেক্টর। উফসি জাতের ব্রিধান-২৮ ৭৮৭০ ও ৭৫ হেক্টর, ব্রিধান-২৯ ৬৮৫৩ ও ১৫০ হেক্টর, ব্রিধান-১৯ ৩শত হেক্টর, ব্রিধান-৫৮ ৮০ হেক্টর, ব্রিধান-৮১ ৮০ ও ১০ হেক্টর, ব্রিধান-৬৭ ৫০ ও ৩০ হেক্টর, ব্রিধান-৬৩ ৪০ হেক্টর, ব্রিধান-৬৯ ৪০ হেক্টর, ব্রিধান-৭৪ ৬০ হেক্টর, ব্রিধান-৮৪ ৪০ হেক্টর, ব্রিধান-৮৮ ১শত ও ১৫ হেক্টর, ব্রিধান-৮৯ ১৫০ ও ২০ হেক্টর, ব্রিধান-৯২ ৫ হেক্টর, বিনা ধান-১৮ ২০ হেক্টর। স্থানীয় জাতের মধ্যে লালডিঙ্গি ১২৯ হেক্টর, রাতা ৩০ ও ৫ হেক্টর, চৈত্র বোরো ২৮ হেক্টর, নাজিরশাইল ৩৩ ও ৫ হেক্টর, কালোজিরা ১০ ও ৫ হেক্টর।
এদিকে বেশি ধান উৎপাদনের আশায় জমিতে হাইব্রিডের আবাদ বাড়ছে, ফলে হারিয়ে যাচ্ছে দেশি ধানের জাত। এ বছর দিরাইয়ে মাত্র ৫ জাতের দেশি ধানের আবাদ করা হয়েছে বলে কৃষি অফিস জানায়।
দিরাই উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার নাহিদ আহমেদ জানান, এ বছর সামান্য ধান পুড়ে যাওয়ায় আমাদের পরামর্শ অনুযায়ি কৃষক তাদের জমিতে পরিচর্যা করায় এখন পর্যন্ত অবস্থা ভালো। যদি কোন কারণে বাঁধ ভেঙ্গে না যায়, তবে আমাদের দেয়া উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তাছাড়া এ বছর কিছু ভালো জাতের ধানের আবাদ করা হয়েছে বলেও তিনি জানান।